চম্পট পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বান্দরবান।
লণ্ডনের
হর্নচার্স শহর। স্বপ্নময় স্কুল “স্কটস প্রাইমারি স্কুল”। ব্রিটিশ
কাউন্সিলের সহযোগীতায় ১২ই জুলাই থেকে ১৭ই জুলাই মোট ৫দিন এই স্বপ্নময়
স্কুলের সাথে (সকাল ৮টা৩০মিনিট থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত) কাজ করার সৌভাগ্য
হয়েছিলো। সত্যিই এক স্বপ্নময় স্কুল। প্রতিটি শিক্ষক-ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে
বিদ্যমান বিশেষ চোখে পড়ার মত গুণ হচ্ছে-‘সততা ও দেশপ্রেম’। দেশের প্রতি
শ্রদ্ধাবোধ দেখে বিমোহিত না হয়ে পারা যায়না।
সকাল ৮টা৩০মিনিটের মধ্যে সব ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে পৌঁছে যায় এবং অভিভাবকেরা
৮টা ৩০ মিনিট হওয়ার সাথে সাথে গেইটের বাইরে চলে যায়। কারণ, ঠিক ৮টা
৩০মিনিটে স্কুল গেইট বন্ধ হয়ে যাবে। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে ৮টা৩০ মিনিট
পর্যন্ত এই আধা ঘণ্টা সময় একজন শিক্ষক গেইটে দাঁড়িয়ে ছাত্রছাত্রীদের রিসিভ
করে নেয়। এরপর নির্দিষ্ট সময়ে গেইট বন্ধ করে দেয়। গেইট দিয়ে ঢুকেই
বাচ্ছারা চলে যায় নির্দিষ্ট পার্টি রুমে (যাকে আমরা আমাদের শিক্ষা
প্রতিষ্টানে কমন রুম হিসেবে উল্লেখ করে থাকি)। ৮টা৩০ থেকে ৯টা পর্যন্ত সময়
হচ্ছে তাদের প্রতিদিনের পার্টি টাইম। সেই রুমে থাকে কিছু চকোলেট ও
বিস্কুট। ঐ সময়টা তারা চকোলেট,বিস্কুট, চিপস খায় ও নিজেরা নিজেরা আনন্দ
উল্লাস করে। ঠিক ৯টা বাজার সাথে সাথে পূর্ব নির্ধারিত ক্লাস টিচার
ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নিজ দায়িত্বে এসেম্বিলী রুমে ঢুকে পড়ে। আশ্চর্যের
বিষয় প্রতিটা শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী এসেম্বিলী রুমের দরজায় পৌঁছার সাথে সাথে
একধম নিশ্চুপ হয়ে যায়। কারো মুখে কোন ধরনের শব্দ আর শুনা যায়না।
তারা বিশ্বাস করে এসেম্বিলীতে কথা বলা মানে দেশের প্রতি অসম্মান করা। কোন
প্রয়োজনে কথা বলতে হলে ফিসফিস করে অথবা ইশারা করে কাজটা শেষ করে। আমাদের
দেশে স্কুল শুরু হওয়ার আগে এসেম্বিলী হয়। এসেম্বিলীতে দাঁড়িয়ে জাতীয় পতাকার
প্রতি সম্মান প্রদর্শন,শপথ বাক্য পাঠ, জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন ইত্যাদি করা
হয়ে থাকে। প্রতিদিন স্কুল শুরু করার আগে আমরা যে শপৎ পাঠ করি তা আমরা
কতটুকু পালন করি তা ঠিক জানিনা।
লণ্ডনের স্কুলে দেখলাম তারা দাঁড়িয়ে এসেম্বিলী করেনা। বড় হল রুম, সব টিচার
পিছনের সারিতে চেয়ারে বসে এবং ছাত্রছাত্রীরা সামনে মেঝেতে বসে। তারা
প্রতিদিন কোন নির্ধারিত জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেনা বা কোন শপৎ বাক্যও পাঠ
করেনা । কিন্তু তাদের ছাত্রছাত্রীদের আচার-আচরণ দেখে মনে হয় তারা জন্মের
সময় শপৎ বাক্য পাঠ করে পৃথিবীতে এসেছে তাই তাদের প্রতিদিন নতুন করে শপৎ
বাক্য পাঠ করতে হয়না। এসেম্বিলীতে তাদের কার্যক্রম হচ্ছে – শুরুতেই
প্রতিদিন একটি দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে কিছু তথ্য শিশুদের সামনে উপস্থাপন
করে। তারপর ( সারা দিনের কর্ম পরিকল্পনা) তারা শিশুদেরকে দিয়ে ৯টা৩০মিনিট
থেকে বিকাল ৩টা৩০মিনিট পর্যন্ত কি কি কাজ করবে তা শ্রেণিভিত্তিক উপস্থাপন
করে এবং সবশেষে একটি দেশাত্ববোধক গানের মাধ্যমে এসেম্বিলী শেষ করা। তার পর
যার যার ক্লাসে চলে গিয়ে ক্লাস শুরু করে। একজন শিক্ষক সপ্তাহে তিন দিন
ক্লাস করে বাকি তিন দিন প্রস্তুতি নেয়। যে শিক্ষক যে ক্লাসের দায়িত্বে সে
শিক্ষক সে ক্লাসই শুধু করায়। তবে প্রতিটা ক্লাসে রয়েছে আলাদা বিষয়ভিত্তিক
শিক্ষক।
ছাত্রছাত্রীদেরকে দিয়ে তৈরি করানো হয় বিভিন্ন ধরনের খাবার যা দিয়ে তাদের
টিফিনের ব্যাবস্থা করা হয়। প্রতিটা ক্লাসে রয়েছে একটি করে স্টোর রুম।
স্টোর রুমে এক একজন বাচ্ছার জন্য ৪টা করে আলাদা ড্রেস( ছবি আঁকার ক্লাস,
নাচের ক্লাস, গানের ক্লাস, স্পোর্টস ক্লাস,জেনারেল ক্লাস) ব্যাগ ও অন্যান্য
প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র রাখা আছে।
বাচ্ছারা যখন যে ক্লাসে যাচ্ছে (ছবি আঁকার
ক্লাস, নাচের ক্লাস,গানের ক্লাস, স্পোর্টস ক্লাস, জেনারেল ক্লাস) তখনই
তারা নিজেরাই নিজেদের জামা-কাপড় বদলে নিয়ে সব গুছিয়ে রাখে। প্লে টাইমে
বাচ্ছারা মনের আনন্দে খেলাধুলা করে বিভিন্ন সরঞ্জাম নিয়ে। ক্লাসে যখন
পূর্ব নির্ধারিত কাজ আরম্ভ করতে যাবে তখন এমন একটি বিষয় তাদের সামনে
উপস্থাপন করা হয় যাতে তারা নিজেরা নিজেরা উৎসাহিত হয়ে কাজগুলো করে থাকে ।
তাদের আর একটা বিষয় দেখলাম,তারা খুবই বন্ধু প্রিয়। কেউ তকে বন্ধু বানাবে
জানলে সে তার জন্য যেকোন ধরনের ছাড় দিতে রাজি আছে। শিক্ষকেরা এই বিষয়টাকে
কাজে লাগিয়ে তাদের কাছ থেকে কাজ আদায় করে নেয়। প্রতিটা ক্লাসে ৩০জন করে
ছাত্রছাত্রী। তাদেরকে বসানো হয় গ্রুপ করে। প্রতিটা গ্রুপে ছয় জন করে পাঁচটা
দলে ভাগ করা থাকে। প্রতিটা ক্লাসে দেয়ালে লাগানো আছে বড় মনিটর। সব
ছাত্রছাত্রীদের জন্য আছে একটি করে ট্যাব। ক্লাসে বই নিয়ে কোন পড়ালেখা নেই,
সব হাতে-কলমে কাজ। ছাত্রছাত্রীদের জন্য নির্ধারিত বই শিক্ষকেরা পড়ে তার
উপর ছাত্রছাত্রীদেরকে দিয়ে কাজ করায়।
প্রতিটা ক্লাসরুম বাচ্ছাদের হাতের তৈরি কাজ দিয়ে সাজানো। সব শিক্ষক
ছত্রছাত্রীদের প্রতি এতটা আন্তরিক যে তা নিজের চোখে না দেখলে ভাষায় প্রকাশ
করা কঠিন। অনেক সময় আমাকে ক্লাস নিতে হয়েছে আবার অনেক সময় তারা যে ক্লাস
নিচ্ছে তা পর্যবেক্ষণ করে বাংলাদেশের সাথে সে দেশের ক্লাসরুমের পার্থক্য
তাদের কাছে জানাতে হয়েছে। প্রতিটা শিক্ষকের আন্তরিক সহযোগীতায় আমি আমার
প্রতিটা কাজ সম্পন্ন করেছি। শিক্ষকের সাথে সাথে কচি কচি বাচ্চাগুলোও এতটা
আন্তরিক যে আমি আশ্চর্য হয়ে যাই। সবার আচরণ দেখে মনে হচ্ছিলো আমি তাদের কত
আপনজন। কিছুদিন কোন কাজের প্রয়োজনে বাইরে ছিলাম, এখন আবার আমাকে সবাই কাছে
পেয়ে খুবই আনন্দিত । দুপুর ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত টিফিন টাইম।
ছাত্রছাত্রীদের টিফিনের ব্যাবস্থা স্কুলেই করা হয়। ছাত্রছত্রীরা নিজেদের
টিফিন নিজেরাই তৈরি করে। এমনকি রিসেপশন ক্লাসের (প্রাক-প্রাথমিক)
ছাত্রছাত্রীরাও তাদের নিজেদের টিফিন তারা নিজেরা তৈরি করে। টিফিন তৈরির
মাধ্যমে তারা শিখছে গণিত, ইংরেজী, বিজ্ঞান,বিশ্বপরিচয় ইত্যাদি বিষয়। ঠিক
বিকাল ৩টা৩০মিনিটে হয় আবার এসেম্বিলী । বিকালের এসেম্বিলীতে উপস্থাপন করা
হয় , “আজ আমাদের কাজের পরিকল্পনা ছিলো এই, পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করে আমরা
এই কাজগুলো করেছি”। এতে করে তারা তাদের কাজ কতটুকু সফল করেছে তা সবার
সামনে উপস্থাপন করা হয়ে যায়। প্রতিটা ক্লাস তাদের সারাদিনের কাজ উপস্থাপন
করার পর পরবর্তি দিনের জন্য শুভ কামনা করে ঐদিনের কাজের সমাপ্তি ঘোষনা করা
হয়। আমি এই ৫দিনে আমাদের দেশের জাতীয় পতাকা, জাতীয় ফুল, জাতীয় পাখি, জাতীয়
মাছ, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দৃশ্য ইত্যাদির ছবি আঁকিয়েছি ছাত্রছত্রীদেরকে
দিয়ে। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের ৪লাইন ইংরেজী বর্ণ দিয়ে (Amar sonar
bangla ami tomay valobasi…..) লিখে শিখিয়েছি. অনেকগুলো বাংলা বর্ণ
শিখিয়েছি। যেমনঃ Dhonyobad, doya kore, shuvo sokal, dudh, ca, cini
ইত্যাদি। বাংলায় কবিতা আবৃত্তি করেছি, বাঙালি সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে
দিয়েছি এবং চম্পট পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রম তাদের
সামনে তুলে ধরেছি। ৪র্থ থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত সব ছাত্রছাত্রী আমাকে
একটি করে মেইল করেছে। আমি তাদের ভালবাসায় মুগ্ধ। তাদের মতো অত্যাধুনিক
সরঞ্জাম, বিভিন্ন রকম সুযোগ-সুবিধা আমাদের বাচ্চাদের পেতে আরো অনেকদিন
লাগবে। তবে আমার একটা বিষয় মনে হলো তাদের ছাত্রছাত্রীদের চাইতে আমাদের
ছাত্রছাত্রীদের মেধা অনেক বেশি। আমাদের ছাত্রছাত্রীদেরকে যদি তাদের স্কুলের
ছাত্রছাত্রীদের মত সুযোগ-সুবিধা দেতে পারি তাহলে তারা অনেক ভালো করতে
পারবে। তবুও আমি আমার মতো চেষ্টা করবো নিজের দেশের প্রেক্ষিতে কিছুটা
হলেও প্রয়োগ করতে। এবং আমি বিশ্বাস করি আমি পারবো। আমার পার্টনার আগামি
১০/১০/২০১৫ইং তারিখ আমার স্কুল ভিজিট করতে আসবে। আমি এমন একজন পার্টনার
পেয়েছি যে, গর্ব করে বলতে পারি আমি সত্যিই ভাগ্যবতী। আমি যাতে আমার
পার্টারের সাথে সুন্দর সম্পর্ক বজায় রেখে আমার কাজ এগিয়ে নিতে পারি তার
জন্য দোয়া করবেন সবাই।
Dear Joynabo Madam, God bless you.
ReplyDelete