Saturday, September 26, 2015

"শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতার উন্নয়নঃ বর্তমান ও ভবিষ্যৎ" - মাছুমা আক্তার।



একটি ভাবনাকে রোপণ কর, তা একটি কর্মে রূপ নেবে। একটি অভ্যাসকে রপ্ত কর, তা একটি চরিত্র গঠন করবে। একটি চরিত্র সৃষ্টি কর, তা ভাগ্যকে নির্ধারণ করবে। একটি মানব শিশুকে নিয়ে এ কথাগুলো বলেছিলেন একজন দার্শনিক। একটি শিশু যখন পৃথিবীতে আসে তখন সে থাকে অসহায়, একতাল নরম কাদামাটির মত। কিন্তু অপার সম্ভাবনাময়। তার বিশাল মস্তিস্ক থাকে অলেখা পাণ্ডুলিপির মত সাদা। এই কাদামাটিকে ছাঁচে ফেলে, আগুনে পুড়িয়ে তাকে শক্ত-পোক্ত একটি মেরুদণ্ড দান করে, তার অলেখা পাণ্ডুলিপিটাকে কালির আঁচড়ে সমৃদ্ধ করে তুলতে পারেন শুধু একজন শিক্ষকই। জ্ঞানে-গুণে, অভিজ্ঞতায় নিজস্ব মেধার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সমাজ দেশ তথা সভ্যতার গতিধারায় সুস্থিতির ভিত রচনা করা সম্ভব কেবল নিজ পেশায় দক্ষ একজন শিক্ষকের পক্ষেই।
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। অন্যভাবে বলা যায়, শিক্ষা জাতীয় উন্নয়নের চাবিকাঠি বা হাতিয়ার। এই হাতিয়ারটি যতবেশি চৌকস, মসৃণ, বেগবান আর ও শক্তিশালী হবে, ততবেশি সফলতা প্রত্যাশা করা যাবে। আর এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষা ব্যাবস্থার প্রতিটি স্তরে দক্ষ শিক্ষক গড়ে তোলা। তাদের পেশাগত দক্ষতার উন্নয়ন সাধন।
গত কয়েক দশকে পৃথিবী যেভাবে এগিয়ে গেছে তাতে দেখা যায় যে, শেখনের ধরন পদ্ধতি, প্রয়োজনসহ অনেক কিছু বদলে গেছে। পূর্বে critical thinking problem solving এর চর্চা থাকলেও এর প্রয়োগ এই শতকে এসে অনেকখানি পাল্টে গেছে। একই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে digital media literacy যা কিনা পঞ্চাশ বছর আগেও ছিলনা। আমরা যে ডিজিটাল যুগে বসবাস করছি এই বোধটা এখনকার শিক্ষার্থীদের ভেতরে আনতে হবে। এমন নয় যে, এই দক্ষতা তৈরি করণের ক্ষেত্রে শিক্ষককে আলাদা করে ক্লাস বা সেমিনারের আয়োজন করতে হবে। ক্লাস চলাকালেই তিনি এর গুরুত্ব উপস্থাপন করতে পারেন। হতে পারে হাতে-কলমে, কোন ভিডিও প্রদর্শনের মাধ্যমে কিংবা কোন বাস্তব ঘটনা বর্ণনা করে। আরও নানা উপায়ে। আর শিক্ষকই সে উপায়গুলো খুজে বের করবেন। আর এর জন্য সবার আগে প্রয়োজন মাল্টি-মিডিয়া ক্লাস। আমাদের দেশে এই কাজটা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। দেশের প্রায় ১৫ হাজার ক্লাসরুমকে ডিজিটাল ক্লাসরুমে পরিণত করা হয়েছে। শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নে এই সময়ে নিঃসন্দেহে এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে আমাদের এটা মনে রাখতে হবে যে, শুধুমাত্র অনলাইন থেকে ছবি, অডিও বা ভিডিও  ডাউনলোড করে পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে লেসনপ্ল্যান তৈরি করলেই হবেনা, এই কাজকে কার্যকরভাবে শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। শিক্ষক নিজে লেসনপ্ল্যান গুলো মাল্টি-মিডিয়ার সাহায্য নিয়ে প্রস্তুত করবেন,  একইসাথে উপস্থাপন করবেন, শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ের সাথে সম্পৃক্ততা বজায় রাখবেন, নিজের কাছে বোধগম্য করবেন ও শিক্ষার্থীদের কাছেও বিষয়টি স্পষ্ট করবেন। একজন শিক্ষককে তাই সবার আগে ভাবতে হবে তিনি শেখাবেন না বরং শিখতে সাহায্য করবেন। এই শতকের দক্ষতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আনতে গেলে একজন শিক্ষককে সেই দক্ষতাগুলো সবার আগে নিজের মধ্যে প্রতিফলিত করতে হবে।
এছাড়াও একজন শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নের একটি শক্তিশালী উৎস বা মাধ্যম হচ্ছে নিজ ক্লাসের পাঠদান পর্যবেক্ষণ। পেশাগত উন্নয়নে ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ এবং মনিটরিং একটি অসাধারণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু সাধারনতঃ আমরা এ কাজটি করিনা বা করার কথাও ভাবিনা।
আত্ম মনিটরিং কেন?
একজন শিক্ষক দীর্ঘকাল ধরে যে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থাকেন, সে হিসেবে তার প্রশিক্ষণ খুব কম হয় বলে আমরা মনে করি।  আমরা মনে করি, একজন শিক্ষক প্রশিক্ষণ পেলেই তার পেশাগত উন্নয়ন ঘটে থাকে। তাকে তারপর আর তেমন কিছুই করতে হয়না। আসলে শিক্ষক প্রশিক্ষণ পেশাগত উনয়নের শুরু-শেষ নয়। শিক্ষকতা জীবন চলাকালীন পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কী কী করা দরকার তা তার জানতে হবে। পাঠদান ফলপ্রসূ হচ্ছে কিনা, শিক্ষার্থীগণ সন্তুষ্ট কি না এ বিষয়গুলো একদিন কিংবা একটি দুটি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নির্ণয় করা যায়না। একজন শিক্ষককেই সেটা আবিস্কার করতে হয়
আত্ম-মনিটরিং একজন শিক্ষককে তার পাঠদান মূল্যায়নে সমালোচনামূলক ও বিশ্লেষণধর্মী সুযোগ প্রদান করে। শিক্ষকের পেশাগত উন্নয়ন কিংবা আত্ম উন্নয়নে রিপ্লেকশন এবং মূল্যায়ন একটি প্রধান চাবিকাঠি। অবিরত শিক্ষক উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে আত্ম-জিজ্ঞাসা।
একজন শিক্ষক হয়তো খুব আত্ম তৃপ্তিতে ভোগেন যে, তিনি তার ক্লাসে ফলপ্রসূ পাঠদান করেছেন এবং তিনি একজন সফল শিক্ষক। কিন্তু বাস্তবে খুব গভীর ও নিগূঢ় দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে এমন কিছু Activity তিনি করাচ্ছেন যা শিক্ষার্থীদের তেমন কোন কাজে লাগছেনা বা তারা উৎসাহ পাচ্ছেনা কিংবা সকল শিক্ষার্থীর আনন্দময় সক্রিয় অংশগ্রহণ হচ্ছেনা। আর এটা শুধু আত্ম-মনিটরিং এর মাধ্যমেই সম্ভব।
আত্ম-মনিটরিং কিভাবে করা যায়? প্রধানত তিনটি পদ্ধতিতে এই আত্ম-মনিটরিং করা যায়।
১। ব্যক্তিগত রিপ্লেকশন/ প্রতিফলন দ্বারা
২। রিপোর্টিং-এর দ্বারা
৩। পাঠের অডিও, ভিডিও রেকর্ডের দ্বারা।
ব্যক্তিগত রিপ্লেকশনঃ
একজন শিক্ষক পাঠদানের সময় কী কী করেছেন সেগুলো তার ডায়েরীতে লিপিবদ্ধ করবেনএটি ক্লাস নেয়ার পর পরই লিখে ফেলতে হবে। শ্রেণিকক্ষে যা যা ঘটেছে এবং শিক্ষকের ব্যক্তিগত অনুভূতি এবং প্রতিক্রিয়া ধারাবাহিকভাবে লিপিবদ্ধ করতে হবে। এক সপ্তাহের বা একমাসের কোন ক্লাসে একজন শিক্ষক কী কী করেছেন, শিক্ষার্থীরা ক্লাস কতটা উপভোগ করেছে, শিক্ষক তাদের সাথে কী রকম আচরণ করেছেন, কে ভুল করেছেন বা লিখেছেন বা বলেছেন ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করা।
আত্ম-রিপোর্টিং-
এই পদ্ধতিতে একটি ইনভেনটরি বা চেকলিস্ট ব্যবহার করতে পারেন একজন শিক্ষক। কী ধরনের শিক্ষাদান পদ্ধতি তিনি ব্যবহার করেছেন বিশেষ কোন পাঠদানের ক্ষেত্রে কিংবা বিশেষ সময়ের মধ্যে কোনটি কতবার ব্যবহার করা হয়েছে। একজন শিক্ষক তাঁর ধারণা মোতাবেক শিক্ষাদান এবং বাস্তবে কিভাবে ক্লাস পরিচালনা করেছেন তার মধ্যে ব্যবধান প্রতিফলিত হয় আত্ম-রিপোর্টিং-এর মাধ্যমে।
পাঠদান রেকর্ডিং-
শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সময় একইসাথে অনেক কিছু ঘটে এবং কিছু কিছু ব্যাপার বা ঘটনা মনে রাখা যায়না ডায়েরী না লেখা পর্যন্ত।  এক্ষেত্রে রেকর্ডিং ভালো কাজ করে। একটি রেকর্ড শ্রেণিকক্ষে ঘটে যাওয়া সব কিছুই ধারণ করে রাখতে পারে, যা ডায়েরী কিংবা রিপোর্টিং-এর মাধ্যমে সম্ভব নয়।  
একজন শিক্ষকের অজানা বিষয়গুলো সনাক্ত করে তা সংশোধনের মাধ্যমে তার অবিরত পেশাগত উন্নয়নে সেলফ মনিটরিং হতে পারে একটি অসাধারণ কার্যকর পদ্ধতি।
একুশ শতকের শিক্ষা আমাদের নিয়ে যায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতার দিকে। এক, জীবন এবং জীবিকা সম্পর্কে দক্ষতা। দুই, শিখন এবং উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে দক্ষতা। তিন নম্বর হল, তথ্য মিডিয়া ও টেকনোলোজি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন। এই দক্ষতাগুলো মূল্যায়নের ক্ষেত্রে, কারিকুলামে, পেশাগত উন্নয়নে ও শিখন পরিবেশে প্রয়োগ করতে হবে। আর শিক্ষকদের এই দক্ষতাগুলো বাড়াতে মোবাইল টেকনোলজির মাধ্যমে ‘নকিয়া এডুকেশন ডেলিভারি’ শীর্ষক একটি অগ্রণী প্রকল্প চালু হয়েছে। এটি একটি সাড়া জাগানো বা  অনুপ্রেরণামূলক প্রকল্প, যেটি তিনবছরে দেশের ৬০০ প্রাথমিক শিক্ষকের শিক্ষাদানের দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করবে।
আমদের দেশের শিক্ষকেরা সাধারনতঃ শ্রেণিকক্ষে পাঠ্যবই ব্যবহার করে থাকেন এবং প্রায়শঃ তাদের ফোনেমিক তথা বা ভাষাগত বা বাচনিক সচেতনতা, উচ্চারণ ও ধ্বনি, সাবলীল পাঠদান ও বর্ণনা, শব্দভাণ্ডার এবং উপলব্ধি প্রভৃতি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব লক্ষ্য করা যায়। মোবাইল টেকনোলজির মাধ্যমে শিক্ষকদের এই দক্ষতা বৃদ্ধি ও জ্ঞানের মান বাড়ানো এবং শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন তথা শিক্ষার মানোন্নয়ন নিশ্চিত হবে বলে আশা করা যায়।
নকিয়া মোবাইল ফোন ও নকিয়া এডুকেশন ডেলিভারী (এনইডি) ব্যবহার করে মুখোমুখি এবং ভার্চুয়াল মেনটরিং যথার্থ পরামর্শমূলক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে ভবিষ্যতে একটি হাইব্রিড মডেল বাস্তবায়ন হবে বলে আমরা আশা করি।
শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। এখনো অনেকে একে একটি ব্রত বলে বিবেচনা করেন। ব্রত পালনের জন্য নানা প্রস্তুতি থাকে, শুদ্ধাচারী হবার প্রয়োজন পড়ে। আমি শিক্ষক। আগামীকাল আমার ক্লাস পরিচালনার জন্য আমি কি নিজেকে প্রস্তুত করি? কোন বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করি নাকি গতানুগতিকতাকেই অনুসরণ করি? কোন একদিন কি বলি, এসো আমরা শব্দ নিয়ে খেলি, অঙ্ক নিয়ে খেলি? অথবা শিশুরা তাদের বাড়ি থেকে স্কুলে আসার পথের মানচিত্র আঁকবে আর আমি স্নেহের দৃষ্টি দিয়ে তা পরীক্ষা করব। কোনদিন কি আলাদা করে বলি, ঐ যে ওই মুক্তিযোদ্ধার কবর এবং তা থেকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প? পাঠ্যবিষয় কেমন করে পরিপার্শ্বের সঙ্গে যোগ করা যায়, কিভাবে শিক্ষার্থীদের সুখ-দুঃখের গল্প শুনে তাদের আত্মীয় হয়ে ওঠা যায়, তা কি ভাবি আমরা? মানসম্মত শিক্ষা অর্জনে সবকিছুর চেয়ে মানসম্মত শিক্ষক তথা পেশাগত দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষকের বড় আকাল। আর তা ঘোচাতে হবে আমাদের নিজেদেরই। 
   তথ্যসূত্রঃ
     ১। মুক্তমঞ্চ
    ২। ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচী
    ৩। শিক্ষা ও উন্নয়ন প্রত্যাশা
    ৪। Education Situation Of Bangladesh      

No comments:

Post a Comment